প্রকাশিত: ৩০/০৯/২০১৬ ১০:৫৫ এএম , আপডেট: ৩০/০৯/২০১৬ ১০:৫৬ এএম

ডেস্ক রিপোর্ট ::
দক্ষিণ এশিয়ায় বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের দুই কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে বুধবার রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর মাধ্যমে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে। হামলায় দুই পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে।

ভারত দাবি করেছে ‘সন্ত্রাসী’দের বেশ কিছু ঘাঁটি ধ্বংস করেছে সেনাবাহিনী। এর মাধ্যমে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ওই হামলার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তারা দাবি করেছে, কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই দেশের সেনাবাহিনীর গোলাগুলিতে দুই পাকিস্তানি সেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে।

ওই ঘটনার পর দেশটির বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এ হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ দু’পক্ষকে শান্ত থাকার আহবান জানিয়েছেন। এ হামলায় ভারতীয় পক্ষে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। গুজরাট থেকে জম্মু পর্যন্ত সীমান্তে হাই অ্যালার্ট জারি করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। হামলার ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বদলীয় বৈঠক করেছেন।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে হামলার বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। খাজা আসিফ বলেন, দেশ রক্ষায় প্রয়োজনে পারমাণবিক হামলা চালাবে তার দেশ। এএফপি, ডন, বিবিসি ও আনন্দবাজার।

ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, পাকিস্তানি ‘সন্ত্রাসী’দের ঠেকাতেই এই অভিযান চালানো হয়। ‘সন্ত্রাসী’রা জম্মু ও কাশ্মীর এবং অন্যান্য এলাকায় হামলা চালানোর জন্য অবস্থান নিয়েছিল। নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই কিলোমিটারের বেশি স্থানজুড়ে আটটি অবস্থানে প্যারা-কমান্ডোর সদস্য এবং হেলিকপ্টার নিয়ে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। বুধবার রাত সাড়ে ১২টায় শুরু হওয়া এ অভিযান চলে ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদের নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটির সঙ্গে বৈঠক করার পর এ অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। বৃহস্পতিবার সকালে নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটির বৈঠক ডাকেন। এরপরই সংবাদ সম্মেলন করে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানের কথা ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপের পাশে বসে দেশটির ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) লে. জেনারেল রণবীর সিং অভিযানের বিষয়ে তথ্য জানান।

রণবীর সিং সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সীমান্তে এ অভিযানের ব্যাপারে পাকিস্তানকে যথাযথ প্রটোকল অনুসরণ করে অবহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ওই অবস্থানগুলোর ওপর নজরদারি করা হয়। সেখানে সন্ত্রাসীরা ভারতে হামলার জন্য অবস্থান নেয়ার পর অভিযান চালানো হয়।

রণবীর সিংহ আরও বলেন, অভিযান ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে এবং এ ধরনের হামলা দ্রুততম সময়ে আবারও চালানোর কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, সম্প্রতি আটক একজন সন্ত্রাসী স্বীকার করেছে, পাকিস্তানে তারা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পেয়েছেন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর এ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন করতে দেয়া হয়নি।

ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল এন এন ভোরা ও মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিকেও অভিযানের বিষয়টি জানানো হয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং সেনাবাহিনীর হাতে দেশ নিরাপদ। সে কারণে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ ‘জঙ্গি’বিরোধী পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছে। এবার অন্তত পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বন্ধ করুক।

ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাসীরা বারবার ভারতে আক্রমণ চালাচ্ছে। পাঠানকোট সেনাছাউনিতে হামলার পর উরি সেনাছাউনি আক্রান্ত হয়। সেখানে ১৮ জন জওয়ান নিহত হন। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। কোনো কিছুতে লাভ না হওয়ায় বাধ্য হয়েই অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।

পাক সেনাবাহিনীর দাবি, ভারতীয় সেনা সদস্যরা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ঢুকে কোনো হামলা চালায়নি। নিয়ন্ত্রণ রেখার অন্য পাশ থেকে ভারত গোলাবর্ষণ করেছে মাত্র। ভারতের গোলাবর্ষণে পাক সেনার দুই জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে বলেও দেশটি স্বীকার করেছে।

পাক সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ভারত বাজার গরম করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে কোনো ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ ভারত করেনি। মাঝে মধ্যেই নিজেদের এলাকা থেকে পাকিস্তানের দিকে ভারত যেভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করে, বুধবার মধ্যরাত থেকেও ভারত তাই করেছে। ভারতের এই গোলাবর্ষণের উপযুক্ত জবাব পাকিস্তান দিয়েছে বলে দেশটির সেনাবাহিনী দাবি করেছে। পাক সেনার তরফে আরও বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের মাটিতে ভারত যদি কোনো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায়, তাহলে পাকিস্তানও একই উপায়ে জবাব দেবে।’

পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ হামলার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এই হামলার নিন্দা করছি। শান্তির লক্ষ্যে কাজ করছি বলে আমাদের যদি কেউ দুর্বল ভাবে, তাহলে ভুল হবে।’

একনজরে রাতের অভিযান : বুধবার রাত সাড়ে ১২টায় কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় নামে ভারতের হেলিকপ্টার। প্যারাসুটে করে ভারতীয় সেনার একটি বিশেষ দলকে নামানো হয় সেখানে। এরপর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ভেতরে ঢোকে ভারতীয় সেনাবাহিনী। অভিযানে ১০০ থেকে ১৫০ জন এলিট কমান্ডো অংশ নেয়। রাত সাড়ে ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত টানা ৪ ঘণ্টা চলে অভিযান। বৃহস্পতিবার সকাল হওয়ার আগেই অপারেশন সফল করে ফিরে আসে ভারতীয় সেনা সদস্যরা।

সীমান্তে প্রভাব : পাঞ্জাবে পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বহু গ্রাম খালি করে দেয়া হয়। বাড়তি বিএসএফ মোতায়েন করা হয় সেখানে। খালি করে দেয়া হয় সীমান্ত লাগোয়া জম্মু-কাশ্মীরের বেশ কিছু গ্রাম। অনেক গ্রামে শুধু স্কুল-বাড়িগুলো খালি করে দেয়া হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ওয়াঘা সীমান্তে ভারত-পাক সীমান্তরক্ষীদের সৌজন্য বিনিময় প্রথা বা বিটিং রিট্রিট অনুষ্ঠানে সাধারণ দর্শকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান : ভারত-পাকিস্তান এ পর্যন্ত চারবার যুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১-তে যুদ্ধের পর ও ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যুদ্ধে জড়িয়েছে তারা। তবে ১৯৭১ ছাড়া প্রতিবারের যুদ্ধই হার-জিতের পরিবর্তে সমঝোতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এবারের উত্তেজনার মধ্যেও দেখা যাচ্ছে, পরমাণু অস্ত্রধারী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধে না জড়ানোর ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন দু’দেশের নীতিনির্ধারকরা। দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ ভারত ও পাকিস্তান। এছাড়াও দুই দেশের সামরিক বাহিনীই জনবল ও অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভারে সমৃদ্ধ।

উত্তেজনার শুরু যেভাবে : ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক বেশ ক’বছর ধরে দুই দেশের সম্পর্কে তুলনামূলক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করলেও তিন মাস আগে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে এক ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতা নিহত হওয়ার পর উত্তাল হয় পৃথিবীর ভূস্বর্গখ্যাত এ উপত্যকা। কাশ্মীরিদের সহিংস প্রতিবাদ বিক্ষোভে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় পাকিস্তান। এর মধ্যে কাশ্মীরের উরি সেনাঘাঁটিতে হামলায় ১৮ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। তখন থেকে শুরু হয় দুই দেশের উত্তেজনা।

ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উরি হামলার পর থেকেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পাকিস্তানকে একঘরে করতে ভারত চেষ্টায় ত্রুটি রাখছে না। পাকিস্তানের হাইকমিশনার আবদুল বাসিতকে ডেকে একাধিক প্রমাণ তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘেও সচেষ্ট ভারত। ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। তারপর এলো এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। সুত্র।  দৈনিক যুগান্তর

পাঠকের মতামত

দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রাখাইন, নতুন আশ্রয়প্রার্থীর আশঙ্কায় বাংলাদেশ

নজিরবিহীন সংকটে পড়তে যাচ্ছে প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নতির সম্ভাবনা না থাকায় ...